দিনের বেলা আকাশের দিকে তাকালে আমরা সূর্যকে দেখতে পাই। রাতের মেঘমুক্ত আকাশ আমাদের বিস্মিত করে। রাতের আকাশে থাকে চাঁদ ও মিটমিট করে জ্বলা অসংখ্য তারা। এদের সৌন্দর্য আমাদের মুখ করে। আমাদের মাথার উপর রয়েছে অনন্ন আকাশ, সীমাহীন ফাঁকা জায়গা বা মহাকাশ। সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, ভারা, মহাকাশ, হায়াগব, গ্যালাক্সি ইত্যাদি দেখা না দেখা সবকিছুকে নিয়ে মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের সকল কিছুকে বলা হয় নভোমণ্ডলীয় কস্তু। এই অধ্যারে আমরা মহাবিশ্ব নিম্নে আলোচনা করব।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• মহাকাশ এবং মহাবিশ্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
• প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যাখ্যা করতে পারব;
• উপগ্রহের কক্ষপথে চলার গতি ব্যাখ্যা করতে পারব;
• কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
• কৃত্রিম উপগ্রহের অবদান উপলব্ধি করতে পারব।
আমরা আকাশের দিকে তাকালে দূর দূরান্তের অনেক বস্তু দেখতে পাই। দিনের আকাশের সূর্য রাতের আকাশের গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি আমাদের চোখে পড়ে। জামরা যদি দুরবীক্ষণ দিয়ে আকাশের দিকে ডাকাই আরও অনেক কিছু দেখতে পাই। বৃহস্পতি গ্রহ তার উপগ্রহসহ লক্ষা করতে থাকে। গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, গ্যালাক্সি ইত্যাদির মাঝখানে যে খালি জায়গা তাকে মহাকাশ বা মহাশূন্য বলে। মহাকাশের দিকে তাকালে আমরা যেসব বস্তু দেখতে পাই তা হলো পদার্থ, যেমন আামাদের এই পৃথিবী। মহাকাশ কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়। মহাকাশ কাতে পদার্থের অনুপস্থিতি বোঝায়। এটা হলো সেই ফাঁকা জায়গা বা অঞ্চল যেখান দিয়ে পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য ও তারারা চলাচল করে।
মহাকাশ বা মহাশূন্যের শুরু, কোথা থেকে
পৃথিবীর মতো এর বায়ুমণ্ডলও মহাকাশে ঘুরছে। এজন্য বায়ুমণ্ডলকে মহাকাশের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। একে পৃথিবীর অংশ হিসেবে বিকেনা করা হয়। তাহলে কোথা থেকে বায়ুমণ্ডলের শেষ এবং মহাকাশের শুরু। অধিকাংশ বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর বেশ কাছাকাছি। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে দূরত্ব বক্ত বাড়তে থাকে বায়ুমণ্ডল তত হালকা হতে থাকে এবং ১৬০ কিলোমিটারের পর বায়ুমণ্ডল থাকে না বললেই চলে। অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন যে, পৃথিবী থেকে ১৬০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলের শেষ এবং মহাকাশের শুরু।
মহাকাশ কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত? মহাকাশের কি কোনো সীমা আছে? এক সময় মানুষ ভাবত, মহাকাশের সীমা আছে। তারা ভাবত যে, যত দূর পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের বস্তুটি ভারা দেখতে পায়, সে পর্যন্তই মহাকাশ বিস্তৃত এবং মহাকাশ বক্রাকৃতির। পরবর্তীতে দূরবীক্ষণ বস্ত্র আবিষ্কারের পর তার দৃষ্টিসীমার বাইরের অনেক গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু ও গ্যালাক্সি দেখতে পেল। তারা সিদ্ধান্তে এলো যে, মহাকাশের কোনো শেষ নেই।
কাজ : বিভিন্ন বই ও ম্যাগাজিন থেকে জেনে নাও মহাকাশ কী। মহাকাশে কী কী আছে? সবকিছু তোমার খাড়ায় নোট করো। অন্য বন্ধুদের সংগৃহীত তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখ। কোনো অমিল পাওয়া গেলে তা শিক্ষকের উপস্থিতিতে শ্রেণিতে উপস্থাপন করো৷ |
এ সৃষ্টি জগতে যা কিছু আছে তার সবকিছু নিয়েই মহাবিশ্ব। ক্ষুদ্র পোকামাকড় ও ধূলিকণা থেকে শুরু করে আমাদের এই পৃথিবী, দূর-দূরান্তের গ্রহ-নক্ষত্র, ধূমকেতু, গ্যালাক্সি এবং দেখা না দেখা সবকিছু নিয়েই মহাবিশ্ব। মহাবিশ্ব যে কত বড় তা কেউ জানে না। কেউ জানে না মহাবিশ্বের আকার বা আকৃতি কেমন। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মহাবিশ্বের শুরু ও শেষ নেই। কেউ কেউ এখনও বিশ্বাস করেন মহাবিশ্বের আকার ও আকৃতি আছে। মানুষ প্রতিনিয়তই মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করছে। তবু, এর অনেক কিছুই এখনও অজানা রয়ে গেছে। এই অজানা হয়তো চিরকালই থাকবে।
অনেক কিছু অজানা থাকলেও বিজ্ঞানীরা এটা জানতে পেরেছেন যে, মহাবিশ্বের অনেককিছুই মহাকাশ নামক সীমাহীন ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মহাবিশ্বের কোনো কোনো অংশে এসব বস্তু বা পদার্থের উপস্থিতি অন্য অংশের চেয়ে বেশি। যেসব অংশে পদার্থ বা বস্তু বেশি জড়ো বা ঘনীভূত হয়েছে তাদের বলা হয় গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রজগৎ। গ্যালাক্সি হলো গ্রহ ও নক্ষত্রের এক বৃহৎ দল। আমাদের বাসভূমি পৃথিবী যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত তার নাম ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে। এরকম কোটি কোটি গ্যালাক্সি রয়েছে মহাবিশ্বে, যেখানে রয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্র।
গ্যালাক্সিগুলো মহাকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়, ঠিক যেন বায়ুমণ্ডলে উড়ে বেড়ানো মৌমাছির ঝাঁকের মতো। মহাকাশের সীমাহীনতার তুলনায় গ্যালাক্সি নক্ষত্রগুলোকে খুব কাছাকাছি মনে হয় আসলে তা নয়। এরা পরস্পর থেকে অনেক দূরে। এদের মধ্যকার দূরত্ব সম্পর্কে তোমাদের একটু ধারণা দেওয়া যাক। আমরা জানি যে, আলো এক সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার পথ যেতে পারে। পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। অন্যদিকে সূর্য থেকে এর সবচেয়ে নিকটবর্তী নক্ষত্র আলফা সেন্টোরিতে আলো পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ বছরের চেয়ে বেশি। এক দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে অন্য দূরবর্তী নক্ষত্রে আলোর পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েক মিলিয়ন বছর। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ নক্ষত্রগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব কত বেশি আর মহাবিশ্ব কত বিশাল।
সৌরজগৎ মিল্কিওয়ে নামক গ্যালাক্সির অন্তর্গত। পৃথিবী থেকে নক্ষত্রগুলোকে দপদপ্ বা মিট্মিট্ করে জ্বলতে দেখা যায়৷ নক্ষত্রগুলো প্রত্যেকে এক একটি জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ড বলে এদের সবারই আলো ও উত্তাপ আছে। মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলোকে তাদের আলোর তীব্রতা অনুসারে লাল, নীল, হলুদ এই তিন বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। অতি বৃহৎ নক্ষত্রের রং লাল, মাঝারি নক্ষত্রের রং হলুদ এবং ছোট নক্ষত্রের রং নীল হয়ে থাকে।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিকাশ সংক্রান্ত যেসব তত্ত্ব আছে তার মধ্যে বহুল প্রচলিত হলো ‘বিগব্যাঙ তত্ত্ব'। বাংলায় একে বলা হয় ‘মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব’। এই তত্ত্বের মতে মহাবিশ্ব একসময় অত্যন্ত উত্তপ্ত ও ঘনরূপে বা ঘন অবস্থায় ছিল যা অতি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল। দ্রুত প্রসারণের ফলে মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং বর্তমান প্রসারণশীল অবস্থায় পৌঁছায়। অতি সম্প্রতি জানা গেছে যে, বিগব্যাঙ বা মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হয়েছিল প্রায় ১৩-৭৫ বিলিয়ন বছর (১৩৭৫ কোটি বছর পূর্বে এবং এটাই মহাবিশ্বের বয়স। বিপব্যাস্ত তত্ত্ব একটি বহু পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যা বেশিরভাগ বিজ্ঞানী গ্রহণ করেছেন। এর কারণ, জ্যোতির্বিদদের পর্যবেক্ষিত প্রায় সকল ঘটনাই এই তত্ত্ব সঠিক ও ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। বর্তমান কালের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এই তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দেন এবং পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।
আমরা আগেই বলেছি যে গ্যালাক্সিতে আমরা বাস করি তার নাম ছায়াপথ। এই ছায়াপথে রয়েছে সূর্য ও এর পরিবার ষাকে সৌরজগৎ বলা হয়। সৌরজগতে রয়েছে সূর্য ও একে ঘিরে আবর্তনশীল ৮টি গ্রহ। যেসব কত সূর্যের চারদিকে ঘুরে তাদের বলা হয় গ্রহ। সূর্যকে ঘিরে আবর্তনশীল আটটি গ্রহ হলো বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন।
কোনো কোনো গ্রহের রয়েছে একাধিক উপগ্রহ। যারা গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরে এদের বলা হয় উপগ্রহ। যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে চাঁদ ভাই চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। সুতরাং, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ এবং চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। নিচের কাজটি করো তাহলে গ্রহ ও উপগ্রহের গতি বুঝতে পারবে।
কাজ : গ্রহ ও উপগ্রহের আবর্তন সম্পর্কে জানা পদ্ধতি : শ্রেণিকক্ষে বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে একটি ফাঁকা জায়গায় যাও। তোমার কোনো বন্ধুকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পীড়াতে বলো। তাকে কেন্দ্র করে একটি বড় বৃত্ত থাক। এই বৃত্তের রেখার উপর ভূমি পাঁড়াও। এবার তোমার অন্য কোনো বন্ধুকে তোমাকে কেন্দ্র করে একটি ছোট বৃত্ত আঁকতে বলো। তোমার বন্ধুকে এই বৃত্ত পথে তোমার চারদিকে ঘুরতে বলো। এখন তুমি তোমাকে ঘিরে আবর্তনকারী বন্ধুসহ প্রথম বন্ধুর চারদিকে বড় বৃত্তপথে ঘুরতে থাক। এখানে তোমার প্রথম বন্ধু হলো সূর্য, ভূমি হলে পৃথিবী আর তোমার দ্বিতীয় বন্ধু হলো চাঁদ। |
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রহের জনের সমর একেকটি নক্ষত্রকে ঘিরে কয়েকটি মহাজাগতিক মেঘ আবর্তিত হতো। এরা নক্ষত্রের আকর্ষণে ঘনিভূত হয়ে অবশেষে জমাট বেঁধে গ্রহে রূপান্তরিত হয়। এভাবেই আবার গ্রহের চারপাশে জমা মহাজাগতিক মেঘ থেকেই উপগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এসব উপগ্রহ হলো প্রাকৃতিক উপগ্রহ।
গ্রহ ও উপগ্রহের কোনো ভালো ও উত্তাপ নেই। এদের উপর সূর্যের আলো পড়ে তা প্রতিফলিত হয়। পৃথিবীর ১টি, মঙ্গলের ২টি, বৃহস্পতির ৬৭টি, শনির ৬২টি, ইউরেনাসের ২৭টি এবং নেপচুনের ১৪টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে।' 'এরা এদের গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে গ্রহের চারদিকে ঘুরে।
মানুষের পাঠানো যেসব বস্তু বা মহাকাশযান পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে তাদের বলা হয় কৃত্রিম উপগ্রহ। রকেটের সাহায্যে এদের উৎক্ষেপণ করা হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টানের প্রভাবে চাঁদের মতো এরা এদের কক্ষপথে ঘুরে । কৃত্রিম উপগ্রহ চাঁদের তুলনায় অনেক ছোট এবং চাঁদের তুলনায় অনেক নিচু দিয়ে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরার জন্য এদের প্রয়োজনীয় দ্রুতি থাকতে হয়। পৃথিবী থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা যত বেশি হবে তার দ্রুতি হবে তত কম। ফলে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে এরা বেশি সময় নেবে। আমরা জানি পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় এর নিজ অক্ষের চারদিকে একবার পাক খায়। সুতরাং, কোনো কৃত্রিম উপগ্রহ যদি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসে তাহলে একে পৃথিবী থেকে স্থির বলে মনে হবে।
কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ যাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরোনো নয়, একেবারেই নতুন। তোমরা জেনে অবাক হবে যে, মহাকাশযাত্রার প্রথম পদক্ষেপটির সূচনা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর। এই যাত্রার সূচনা করে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন। তারা স্পুটনিক-১ নামক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। স্পুটনিক শব্দের অর্থ হলো ভ্রমণসঙ্গী। একই বছর ২রা নভেম্বর স্পুটনিক-২ নামক আরেকটি কৃত্রিম উপগ্রহ তারা মহাকাশে পাঠান। প্রথম মার্কিন কৃত্রিম উপগ্রহের নাম এক্সপ্লোরার-১। এই উপগ্রহ ১৯৫৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মহাকাশে পাঠানো হয়। ভস্টক-১ নামক সোভিয়েট কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষ নিয়ে প্রথম পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। যে মানুষটি প্রথম মহাকাশে গিয়েছিলেন তার নাম সোভিয়েট ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগারিন। তিনি ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল ভস্টক-১ কৃত্রিম উপগ্রহে চড়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। ভস্টক-৬ নামক কৃত্রিম উপগ্রহে (মহাকাশযান) চড়ে প্রথম সোভিয়েট নারী মহাকাশচারি ভেলেনটিনা তেরেসকোভা মহাকাশে ঘুরে আসেন ১৯৬৩ সালে। ইনটেলসেট-১ কৃত্রিম উপগ্রহকে পাঠানো হয় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য যোগাযোগ উপগ্রহ হিসেবে। রিমোটসেনসিং বা দূর অনুধাবনের জন্য পাঠানো প্রথম উপগ্রহ হলো ল্যান্ডসেট-১। একে পাঠানো হয় ১৯৭২ সালে। আন্তর্জাতিক যোগসূত্র স্থাপনের জন্য অ্যাপোলো-সয়োজ টেস্ট প্রজেক্ট নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রথম পাঠানো হয় ১৯৭৫ সালে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ পর্যন্ত হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে। কয়েক শত কৃত্রিম উপগ্রহ বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং হাজার হাজার অব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহ বা তাদের অংশবিশেষ মহাকাশ ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।
পৃথিবীর চারদিকে ঘুরার জন্য কেন্দ্রমুখি বল বা টানের প্রয়োজন হয়। কৃত্রিম উপগ্রহের উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল বা অভিকর্ষ বলই এই কেন্দ্রমুখি বল জোগায়। হিসাব করে দেখা গেছে যে, যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে পৃথিবীর প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উপরে তুলে পৃথিবী পৃষ্ঠের সমান্তরালভাবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮ কিলোমিটার বেগ দেওয়া যায় তবে কত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকবে। কিন্তু এত উপরে তুলে কোনো বস্তুকে এত বেশি বেগ দেওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কারণ, বায়ুস্তরের সাথে তীব্র সংঘর্ষে এত তাপ উৎপন্ন হবে যে, বস্তুটি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তিনটি রকেটের সাহায্যে কৃত্রিম উপগ্রহকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় তুলে পরে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বেগ দেওয়া হয়। তখন কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। কৃত্রিম উপগ্রহ কীভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে তা জানতে নিচের কাজটি করো।
কাজ : পৃথিবীর চারদিকে কৃত্রিম উপগ্রহের আবর্তন সম্পর্কে জানা পদ্ধতি : একটি টেনিস বলকে প্রায় ১ মিটার লম্বা একটি সুতার এক মাথায় শক্ত করে বাঁধ। এবার সুতার অপর মাথা এক হাতে শক্ত করে ধরে অপর হাতে বলটি ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে ছুড়ে দাও। দেখবে কলটি সামনের দিকে সামান্য গিয়ে বৃত্তাকার পথে যেতে চাইছে। সুতার মাথা ধরে বলটি ঘুরালে বলটি সুতার টানে বৃত্তাকার পথে ঘুরবে। এখানে তুমি হলে পৃথিবী, বল হলো কৃত্রিম উপগ্রহ এবং সুতার টান হলো অভিকর্ষ বল। বৃত্তাকার পথটি হলো কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ। |
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ উৎক্ষেপণের পর কৃত্রিম উপগ্রহ কেন পৃথিবীর চারদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে।
কৃত্রিম উপগ্রহ নানান রকম কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার অনুসারে এদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন— যোগাযোগ উপগ্রহ, আবহাওয়া উপগ্রহ পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী উপগ্রহ, সামরিক বা গোয়েন্দা উপগ্রহ, নৌপরিবহন উপগ্রহ ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক উপগ্রহ।
যোগাযোগ উপগ্রহ
আমরা অনেকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা অন্য যেকোনো দেশে আত্মীয়-স্বজনের সাথে টেলিফোনে কথা বলে থাকি। আমরা যখন টেলিফোনে অন্য দেশের কারো সাথে কথা বলি, তখন আমাদের দেশের কোনো ডিশ এরিয়েল থেকে একটি বেতার সঙ্কেত কৃত্রিম উপগ্রহে প্রেরিত হয়। উপগ্রহটি সঙ্কেতটিকে অপর দেশের কোনো একটি ডিশ এরিয়েলে পাঠিয়ে দেয়, সেখান থেকে যার সাথে কথা বলছি তার টেলিফোনে পৌঁছায়।
এছাড়া আমরা বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বা অলিম্পিক গেইম টেলিভিশনে দেখে থাকি। অন্যদেশ থেকে একইভাবে বেতার সঙ্কেত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে আমাদের টেলিভিশনে পৌঁছায়। যে দেশে খেলা হচ্ছে সে দেশ থেকে ডিশ এরিয়েলের মাধ্যমে একটি সঙ্কেত উপগ্রহে পাঠানো হয়। উপগ্রহ সঙ্কেতটি পুনরায় আমাদের দেশের কোনো ডিশ এরিয়েলে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে আমাদের টেলিভিশনে পৌঁছে। কৃত্রিম উপগ্রহ এখানে রিলে স্টেশনের কাজ করে। এই উপগ্রহ টেলিভিশন প্রোগ্রাম ও টেলিফোন সংবাদ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বয়ে নিয়ে যায়। এর নাম তাই যোগাযোগ উপগ্রহ।
আবহাওয়া উপগ্রহ
আমরা টেলিভিশন ও রেডিওতে আবহাওয়ার খবর শুনি এবং পত্রিকায় আবহাওয়ার খবর পড়ি। এসব মাধ্যম আবহাওয়ার এই পূর্বাভাস কোথা থেকে পায়? আবহাওয়া উপগ্রহ আবহাওয়ার পূর্বাভাসদানকারী ব্যক্তিদের জানিয়ে দেয় ঐ দিনের বা পরবর্তী কয়েক দিনের আবহাওয়া কেমন হবে, কোথায় মেঘ সৃষ্টি হচ্ছে, কোন দিকে মেঘ যাচ্ছে বা কোথায় কখন বৃষ্টি হতে পারে। বায়ু প্রবাহ, সাইক্লোন সৃষ্টি হওয়া, কোথায় ঘনীভূত হচ্ছে, কোন দিকে আঘাত হানতে পারে তার সবকিছু এই উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ করে পূর্বাভাস দিতে পারে। এজন্য এই উপগ্রহের নাম আবহাওয়া উপগ্রহ।
পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী উপগ্রহ
এই উপগ্রহ পৃথিবীপৃষ্ঠের সুস্পষ্ট চিত্র দিতে পারে। সমুদ্রে কোন জাহাজ থেকে তেল চুইয়ে কোথায় পরিবেশ দূষণ করছে, কোন শহরের বায়ু দূষিত ও ময়লা তা এই উপগ্রহের সাহায্যে ছবি তুলে জানা যেতে পারে। কোন মাঠে ফসল ভালো হচ্ছে, কোনো ফসলে রোগবালাই বা পোকামাকড় আক্রমণ করেছে কি না, তা জানতে তথ্য ও ছবি এই উপগ্রহ পাঠাতে পারে। বনে কোথায় আগুন লেগেছে, কোনো জাহাজের যাত্রাপথে হিমবাহ আছে কি না তা জানতে এই উপগ্রহ সহায়তা করতে পারে। মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ নির্ণয়ের জন্যও এই উপগ্রহ ব্যবহার করা হয়।
সামরিক বা গোয়েন্দা উপগ্রহ
গোয়েন্দার কাজ করার জন্য সামরিক বাহিনীতে এই উপগ্রহ ব্যবহার করা হয় তাই এর নাম গোয়েন্দা উপগ্রহ। প্রতিপক্ষ যোদ্ধারা কোথায় লুকিয়ে আছে, গোপনে তারা কোথাও অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে কি না, কোনো গোপন আক্রমণ হচ্ছে কি না ইত্যাদি খবর সংগ্রহের জন্য এই উপগ্রহ ব্যবহার করা হয়।
নৌপরিবহন উপগ্রহ
আমরা গাড়ি, বিমান বা জাহাজে ভ্রমণ করে থাকি। বিশাল সমুদ্রে জাহাজ কী করে এর অবস্থান নির্ণয় করে? কোন বিমান আকাশে কোথায় আছে তা কী করে জানে? এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবার সময় কী করে বুঝতে পারে কোথায় আছে? গাড়ি, সামুদ্রিক জাহাজ ও বিমান এদের অবস্থান সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য নৌপরিবহন উপগ্রহের সহায়তা নিয়ে থাকে।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক উপগ্রহ
এই উপগ্রহে রাখা টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণযন্ত্র মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দিয়ে
থাকে।
নতুন শব্দ : মহাবিশ্ব, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ, কৃত্রিম উপগ্রহ
এই অধ্যায় পাঠ শেষে যা শিখলাম-
- গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, গ্যলাক্সি ইত্যাদির মাঝখানে যে খালি জায়গা থাকে তাকে মহাকাশ বা মহাশূন্য বলে । মহাকাশ কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়।
- সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, তারা, মহাকাশ, ছায়াপথ, গ্যালাক্সি ইত্যাদি দেখা না দেখা সবকিছুকে নিয়ে মহাবিশ্ব।
- মহাবিশ্বের যেসব অংশে পদার্থ বা বস্তু বেশি জড়ো বা ঘনীভূত হয়েছে তাদের বলা হয় গ্যালাক্সি ।
- যে গ্যালাক্সিতে আমরা বাস করি তার নাম ছায়াপথ। এই ছায়াপথেই রয়েছে সৌরজগৎ।
- সূর্য একটি নক্ষত্র। সূর্যের রয়েছে আটটি গ্রহ। এরা হলো- বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন।
- নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে যারা ঘুরে তাদের বলা হয় গ্রহ। গ্রহকে কেন্দ্র করে যারা ঘুরে তাদের বলা হয় উপগ্রহ।
- মানুষের পাঠানো যেসব মহাকাশযান পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে তাদের বলা হয় কৃত্রিম উপগ্রহ।
- কাজ অনুসারে কৃত্রিম উপগ্রহের নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন- যোগাযোগ উপগ্রহ, আবহাওয়া উপগ্রহ, পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী উপগ্রহ, সামরিক বা গোয়েন্দা উপগ্রহ, নৌপরিবহন উপগ্রহ, জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক উপগ্রহ।